Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

স্থানীয় সরকার নেতাদের অ্যাসোসিয়েশন কেন প্রয়োজন

Icon

ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্থানীয় সরকার নেতাদের অ্যাসোসিয়েশন কেন প্রয়োজন

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি হলো নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নানা সময়ে, নানা নীতিগত প্রশাসনিক, সাংগঠনিক, আইনগত ও অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে নানারূপ অসুবিধার সম্মুখীন হন। এ প্রেক্ষাপটে একটি শক্তিশালী সমিতি বা অ্যাসোসিয়েশন টেকসই স্থানীয় সরকার, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জাতীয় কণ্ঠস্বর হিসাবে কাজ করে, যা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে, এর উন্নয়ন ঘটাতে এবং জাতীয় পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের স্বার্থরক্ষা করতে সহায়ক হতে পারে। স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন মূলত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি জাতীয় প্ল্যাটফর্ম। এর প্রধান লক্ষ্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমর্থন করা, তাদের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং জাতীয় সরকারের কাছে স্থানীয় সরকারের প্রয়োজন ও দাবি তুলে ধরা।

স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন স্থানীয় ও জাতীয় সরকারের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধ তৈরি করতে পারে। স্থানীয় সরকারের মুখপাত্র হিসাবে কাজ করা, জাতীয় সরকার এবং অন্যান্য অংশীজনদের কাছে স্থানীয় সরকারের স্বার্থ তুলে ধরা স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম প্রধান কাজ। এছাড়াও নানা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে সহযোগিতা ও নেটওয়ার্কিং বাড়ানো, যাতে তারা একে অপরের কাছ থেকে ভালো কাজগুলো শিখতে ও ভাগ করে নিতে পারে, সে ক্ষেত্রেও স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। স্থানীয় সরকারগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং উন্নত সেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ, তথ্য এবং প্রশিক্ষণ সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের জন্য সহায়ক নীতি ও আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে প্রভাব বিস্তার করাও স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশনগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ‘লোকাল গভর্নমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’ ৩১৭টি ইংলিশ কাউন্সিল এবং ২২টি ওয়েলশ কাউন্সিলের সমন্বয়ে গঠিত, যা স্থানীয় সরকারের জাতীয় কণ্ঠস্বর হিসাবে পরিচিত। এ সংস্থাটি জাতীয় সরকারের কাছে স্থানীয় সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল এবং ক্ষমতা আদায়ে সর্বদা সচেষ্ট। শুধু তাই নয়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সুনাম বৃদ্ধি এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও জ্ঞান বিনিময়েও সহায়তা করে থাকে। নেদারল্যান্ডসের ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ নেদারল্যান্ডস মিউনিসিপ্যালিটিস’, যা ১৯১২ সালে ২৮টি ডাচ শহর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, বর্তমানে ৩৪২টি ডাচ পৌরসভার স্বার্থরক্ষায় কাজ করে চলেছে। ভিএনজি, ভিএনজি ইন্টারন্যাশনাল নামক একটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতেও ভূমিকা রাখে।

অস্ট্রেলিয়ান লোকাল গভর্নমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন দেশের ৫৩৭টি কাউন্সিলকে প্রতিনিধিত্ব করে, নানা জাতীয় সংস্থায় স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে এবং স্থানীয় সরকারের উদ্বেগকে জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরে। মালয়েশিয়ার ‘মালয়েশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ লোকাল অথরিটিজ’ ২০০০ সালে গঠিত, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ও ভাবমূর্তি বাড়াতে এবং স্থানীয় সরকারগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করতে কাজ করে। এমনকি ভারতের কেরালা রাজ্যেও ‘গ্রাম পঞ্চায়েত সমিতি’ ১৯৬৬ সাল থেকে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে গবেষণা, আলোচনা, সেমিনার ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করে আসছে। ‘কেরালা ইনস্টিটিউট অব লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ স্থানীয় সরকার সমিতির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত, স্থানীয় সরকার এবং বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ উদাহরণগুলো থেকে স্পষ্ট, স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন কেবল একটি সংস্থা নয়, এটি স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বিভিন্ন দেশে স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন স্থানীয় সরকারের স্বার্থরক্ষা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জাতীয় পর্যায়ে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা এখনো দুর্বল এবং নানা সমস্যায় জর্জরিত। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই সীমিত ক্ষমতা, অপর্যাপ্ত তহবিল এবং জাতীয় সরকারের ওপর বেশি নির্ভরশীলতার মধ্যে থাকে। এ পরিস্থিতিতে একটি শক্তিশালী এবং টেকসই স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং ভালো কাজগুলোর অভিজ্ঞতা বিনিময়ের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবে, যা প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার মাধ্যমে স্থানীয় সরকার কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করবে। স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং নেটওয়ার্কিং বৃদ্ধি করবে, যা স্থানীয় সরকারগুলোকে একে অপরের সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে জানতে এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করবে। একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি নাগরিকবান্ধব এবং জবাবদিহিমূলক হতে উৎসাহিত করবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন স্থানীয় সরকারগুলোকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সহায়তা করতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্যদূরীকরণ এবং পরিবেশ রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্থানীয় সরকারগুলোর ভূমিকা বাড়াতে স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশে বর্তমানে বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ফোরাম (বিইউপিএফ), উপজেলা পরিষদ ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ (ইউপিএফবি), এবং মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (এমএবি)-এর মতো স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন বিদ্যমান থাকলেও এদের কার্যক্রম খুবই সীমিত ও সমন্বয়হীন। একটি টেকসই এলজিএ গঠনের মাধ্যমে এ সংস্থাগুলোকে একত্রিত করে আরও শক্তিশালী এবং কার্যকর প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা সম্ভব। বাংলাদেশে একটি টেকসই স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন গঠনের সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল। প্রয়োজন শুধু স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের আন্তরিক ও সমন্বিত প্রচেষ্টা, স্থানীয় সরকারবান্ধব সুশীল সমাজের সুদৃষ্টি এবং সরকারের সহযোগিতা।

স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশনকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করলে এটি স্থানীয় সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল, ক্ষমতা এবং স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে পারে। এ লক্ষ্যে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, বিইউপিএফ, ইউপিএফবি এবং এমএবির মতো সংস্থাগুলোকে একত্রিত করে একটি জাতীয় স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন গঠন করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশনকে একটি শক্তিশালী আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দেওয়া প্রয়োজন, যা এটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে এবং সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় স্বীকৃতি ও সমর্থন পেতে সাহায্য করবে। তৃতীয়ত, স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি শক্তিশালী তহবিল তৈরি করা দরকার, যা মূলত সদস্য চাঁদা, বেসরকারি অনুদান এবং নানা সামাজিক উৎস থেকে আসতে পারে। চতুর্থত, স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশনের কর্মী ও সদস্যদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের আয়োজন করা আবশ্যক। পঞ্চমত, জাতীয় পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের স্বার্থে নিয়মিত আলোচনা ও অ্যাডভোকেসি এবং সরকারের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার মত দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

সরকারি সহায়তা ও অনুদাননির্ভর কোনো সংঘ, সংস্থা, সমিতি বা অ্যাসোসিয়েশন নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করতে পারবে না। অতীতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও দাতা সংস্থানির্ভর কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও তারা কার্যকর অবদান রাখতে পারেনি। বিভক্ত ও খণ্ডিত অনেক সমিতি/সংস্থা গঠিত হয়। সব সংস্থায় গণতান্ত্রিক নীতিকাঠামোর অভাব ছিল। তাই স্থানীয় সরকার অ্যাসোসিয়েশন গঠনের সময় তিনটি প্রধান বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হবে।

স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তর ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পৃথক পৃথক সমিতি হবে, নাকি সব সদস্য ও কাউন্সিলরদের একটি মাত্র জাতীয় সমিতি হবে? পৃথক পৃথক স্তর ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সমিতি হলে সব প্রতিষ্ঠানের মিলিত একটি গণতান্ত্রিক ফেডারেশন থাকা প্রয়োজন হবে। নতুন প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সদস্য/কাউন্সিলর প্রধান, তাই সবার একটি জাতীয় সমিতি হতেও বাধা থাকার কথা নয়। তবে দলবাজির কারণে নানা উপদলে বিভক্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। একটি স্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র এবং সে গঠনতন্ত্রের আওতায় অর্থ সংগ্রহ ও তার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে স্বচ্ছতা অপরিহার্য। উপরের তিনটি বিষয়ে ঐকমত্য হলে ধাপে ধাপে একটি স্বচ্ছ, সুন্দর, গতিশীল ও দেশব্যাপী শক্তিশালী একটি স্থানীয় সরকার সমিতি গড়ে উঠতে পারে। এ সমিতি স্থানীয় সরকারের পক্ষে নানা নীতি-বিতর্ক সৃষ্টি ও তার মাধ্যমে সরকারের স্থানীয় সরকার ও বিকেন্দ্রীকরণ নীতিতে ইতিবাচক ধারাযুক্ত করতে পারে।

ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম